হৃদয় হোসাইন,পাবনা:
ফসলের জমিতে কৃষকরা ‘কাকতাড়ুয়া’ (মানুষের প্রতীক) বানিয়ে পুঁতে রাখে। আধুনিক কৃষি আর বিভিন্ন কীটনাশক আসায় এখন এটি আর আগের মতো দেখা যায় না। দেশের উত্তর অঞ্চলের শস্য ভান্ডার পাবনা জেলার সাঁথিয়া,বেড়া,সুজানগর সহ সকল উপজেলার কৃষক জমিতে কাকতাড়ুয়া পুঁতে রাখে। তাদের বিশ্বাস ছিল জমিতে কাকতাড়ুয়া থাকলে ফসলে রোগ,পোকা মাকড় হবে না এবং কারো ক্ষতিকর নজরও লাগবে না।কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে সনাতন পদ্ধতিগুলো। এখন কৃষক আধুনিক পদ্ধতির রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে ফসল চাষাবাদ করে এবং রোগবালাই দমন করে। তবে কিছু কৃষক এখনো সেই সনাতন কাকতাড়ুয়া পদ্ধতি ব্যবহার করে ফসল রক্ষার জন্য। কাকতাড়ুয়া তৈরির পদ্ধতি বেশ সহজ। বাঁশ,খড়, মাটির হাড়ি, দড়ি,কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয় কাকতাড়ুয়া। যা দেখতে অনেকটা দু হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মতো। মাথার আকৃতি দিতে কেউ খড় ব্যাবহার করে। খরের ওপর কাপড় পেঁচিয়ে আবার কেউবা মাটির হাড়ি বসিয়ে হাড়িতে সাদা রঙ বা কয়লা দিয়ে চোখ মুখের ছবি একে দেয় যা দেখতে কিছুটা মানুষের প্রতিকৃতির মতো হয়। এরপর শরীর ঢাকতে পুরনো শার্ট বা গেঞ্জি পরিয়ে ফসলের জমিতে পুঁতে রাখে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় অবিকল মানুষের মতো কেউ দাঁড়িয়ে আছে। পশু প্রাণীরা একে মানুষ ভেবে বিভ্রান্ত হয়। পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার করমজা ইউনিয়ন এর বাঐটোলা,বায়া,আটিয়াপাড়া,সহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে মাঠের পর মাঠ ফসলের ক্ষেত। হঠাৎ দু-একটি জমিতে চোখে পড়ে কাকতাড়ুয়া। দূর থেকে দেখে মনে হয় কেউ জমিতে দাঁড়িয়ে আছে। কৃষকদের বিশ্বাস কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করলে জমির ফসল ভালো হয়। গ্রাম-বাংলায় কৃষক ক্ষেতের ফসলকে পাখি, ইঁদুর ও মানুষের কু-নজরের হাত থেকে রক্ষা করার কৌশল হিসেবে অদ্ভূত ও অভিনব পদ্ধতির আবিষ্কার করেন আদিকাল থেকে এরকম এক প্রহরী যার নাম কাকতাড়ুয়া। গ্রাম-বাংলার গ্রামীণ জনপদে ফসলের ক্ষেতের অতি পরিচিত দৃশ্য এই কাকতাড়ুয়া। কালের প্রবাহে ফসল রক্ষার এই পদ্ধতিটি গ্রাম-বাংলার বিমূর্ত প্রতীক হয়ে উঠে আসে গল্প, কবিতা, নাটক,সিনেমায়। এরপর কাকতাড়ুয়া আধুনিক সমাজে পৌঁছে যায় শিল্পীর চিত্রকর্মে বইয়ের প্রচ্ছদে প্রচ্ছদে। কাকতাড়ুয়া হচ্ছে কাক কিংবা অন্যান্য পশু-পাখিকে ভয় দেখানোর জন্য জমিতে রক্ষিত মানুষের প্রতিকৃতি বিশেষ। এর মাধ্যমে পশু-পাখিকে ক্ষেতের ফসল কিংবা বীজের রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে নিরুৎসাহিত করা হয়। কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করে ফসলের জমিতে ইঁদুর দমনে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া নিশাচর প্রাণীরা জমিতে বিচরণ করার সময় ভয় পায় ফসলেরও সুরক্ষা হয়। কৃষকদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। সাধারণত ধান ও সবজির জমিতেই কৃষকরা কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করে থাকে। কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার নিয়ে বাঐটোলা গ্রামের কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা হলে তারা বলেন,আগে জমিত কাকতাড়ুয়া ব্যাবহার করতাম। এখন আর করি না, সেসময় আমাদের বিশ্বাস ছিল জমিতে কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করলে ফসলে রোগ হয় না,ফলনও ভালো হয়। আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি আবিষ্কার করার ফলে পরবর্তী সময়ে এই পদ্ধতিগুলো বিলুপ্ত হতে শুরু করে। তবে কিছু কৃষক এখনো কাকতাড়ুয়া পদ্ধতি ব্যবহার করে। কাকতাড়ুয়ার ব্যাবহার নিয়ে ঔই এলাকার কলেজ শিক্ষার্থী বিপ্লব হোসেন বলেন,একসময় গ্রামের মানুষের মাঝে সচেতনতার অভাব ছিল। নানা কুসংস্কার এবং প্রথার প্রচলন ছিল। এত আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ছিল না তাই কৃষকরা ফসল ফলাতে পূর্বপুরুষদের দেখানো চাষ পদ্ধতি ব্যাবহার করত। এখন বিজ্ঞানের যুগ সবকিছুই আধুনিকায়ন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কৃষির উন্নয়নে নানা প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। তাই কৃষক কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার আগের মতো করছে না। এ বিষয় সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার সঞ্জীব কুমার গোস্বামী বলেন,কৃষক ফসলের জমিতে পাখিদের ভয় দেখানোর জন্য কাকতাড়ুয়া ব্যাবহার করে। আগের তুলনায় এখন এর ব্যাবহার কমে এসেছে। চাষাবাদে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় কৃষক আগের মত আর কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করছে না। অনেকে গাছের পাতা ছাড়া ডাল ব্যাবহার করতো এখন সেটিও আর করে না। দিন দিন উপজেলার প্রতিটি এলাকায় কৃষকের কাছে পার্চিং ও আলোকফাঁদ পদ্ধতির ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আমরা উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে সবসময় বিভিন্ন পোকামাকড় থেকে ফসল রক্ষ করতে কৃষকদের সচেতন করছি।
Leave a Reply