
নিজস্ব প্রতিবেদক:
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলা ভূমি অফিসের (এসিল্যান্ড) সার্ভেয়ার নুরে আলমের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জাল জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে।
নিজের ভিটেমাটির জাল দলিল ও অবৈধ দখলসহ বিভিন্ন কারণে অতিষ্ট ভুক্তভোগীরা বাধ্য হচ্ছেন মিস কেস করতে। অভিযোগ উঠেছে, নিজের ভিটেমাটির সুরক্ষার জন্য তারা ভূমি অফিসে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সার্ভেয়ার নূরে আলমের।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুস দাবি করেন এ ভূমিকর্মকর্তা। তার দাবি করা ঘুসের টাকা দিতে ব্যর্থ হলে রায় যায় বিপক্ষে।
নুরে আলম তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে কর্মরত আছেন সোনারগাঁও ভূমি অফিসে। এ সময়ে অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। মিস কেসে ভূমির সরেজমিন প্রতিবেদন দিতে নয়ছয়ের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সোনারগাঁওয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নের ভবনাথপুর গ্রামের মো. আতাউর রহমান ভূমি কর্মকর্তার জালিয়াতির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ তার ছেলে তাওলাদ হোসেনের।
তাওলাদ জানান, প্রায় ৫ বছর আগে জাল দলিলের মাধ্যমে একটি চক্র তাদের সম্পত্তি দখলের চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে ভূমি অফিসে মিস কেস করেছিলেন তার বাবা আতাউর।
এরপর থেকে মাসে দুবার, কখনও ৩ মাসে একবার হাজিরা দিয়ে আর ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের কাছে তদবির করে প্রায় আড়াই বছর পার করার পর একদিন জানতে পারেন তার মামলাটি খারিজ হয়ে গেছে। পরে ভুক্তভোগী জেনেছেন এর নেপথ্যে সেই সার্ভেয়ার নূরে আলম।
তাওলাদ অভিযোগ করেন, তার প্রতিপক্ষ সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানের কাছ থেকে সার্ভেয়ার নূরে আলম মোটা অংকের ঘোস নিয়ে তার পক্ষে রায় রিপোর্ট দিয়ে মামলাটি খারিজ করে দেন।
তিনি বলেন, জায়গাটি পুরোপুরি আমার দখলে কিন্তু সরেজমিন তদন্ত করতে গিয়ে সার্ভেয়ার নুরে আলম জমিটি আমার প্রতিপক্ষের দখলে বলে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়েছেন।
আমার অগোচরে মামলার তারিখ ফেলে আমাকে গড় হাজির দেখিয়ে মামলাটি খারিজ করার সব আয়োজন করেছেন তিনি। তার সঙ্গে ভূমি অফিসের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাও জড়িত। তিনি মামলাটি পূনঃতদন্তের আবেদন করলে সেটি গৃহীত হয়। কিন্তু সেটিও দীর্ঘ সময় ধরে ফেলে রাখা হয়।
তাওলাদ জানান, জমি সংক্রান্ত জটিলতা আর ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার ও কর্মকর্তাদের অসহযোগিতায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তার বাবা আতাউর। পরে অসুস্থ হয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে আতাউর রহমান মৃত্যুবরণ করেন।
অভিযোগ উঠেছে, মো. আতাউর রহমানের মতো অনেকেই বেপরোয়া এ সার্ভেয়ারের ঘুস বাণিজ্যের শিকার হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। অনেক হত দরিদ্র মানুষের ভিটেমাটি হাতছাড়া হচ্ছে। এসব অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়ে খুব কম মানুষই প্রতিবাদ করেন।
সার্ভেয়ার নূরে আলমের বিরুদ্ধে সোনারগাঁও পৌরসভার খাগুটিয়া এলাকার মৃত আব্দুল মালেক বেপারীর ওয়ারিশরা অভিযোগ করেছেন যে, তারা ৫ ভাই ও ৩ বোন দীর্ঘদিন ধরে বাগমহিষা মৌজায় আরএস খতিয়ান ১০, দাগ নং এসএ ২২ ও আরএস ১৬৪ এর ২৯ শতাংশ জায়গা ওয়ারিশ সূত্রে ভোগ দখল করে আসছেন।
২০২০ সালে আবদুল মালেক বেপারী মারা গেলে তার ভাই মৃত সামছুদ্দিনের ছেলে মো. জাকির হোসেন ওই জমির ৬ শতাংশের মালিকানা দাবি করে হুমকি ধমকি দিয়ে আসছিলেন। পরিপ্রেক্ষিতে আবদুল মালেক বেপারীর ওয়ারিশরা নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি দেওয়ানী মোকদ্দমা দায়ের করেন।
এতে আদালত ২০২২ সালের ৪ এপ্রিল নালিশা জমির ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য দুপক্ষকে সতর্ক করে আদেশ দেন আদালত।
এরপর মো. জাকির হোসেন আদালতে পাল্টা মামলা করতে গেলে উচ্চ আদালতে এ সংক্রান্ত মামলা চলমান থাকায় তা খারিজ হয়ে যায়।
এর আগে মো. জাকির হোসেন সোনারগাঁও ভূমি অফিসে একটি মিস কেস (নম্বর-৩২৬/২০২০) করেছিলেন। পরিপ্রেক্ষিতে সার্ভেয়ার নুরে আলম ২০২১ সালের ৯ মার্চ নোটিশ করে বাদী ও বিবাদীকে ২৫ মার্চ সোনারগাঁও ভূমি অফিসে হাজির হতে বলেন।
সে মোতাবেক দুপক্ষের কাগজপত্র দেখে তৎকালীন ভূমি কমিশনার গোলাম মুস্তাফা মুন্না জমি নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা থাকায় শুনানি করলেও কোনো রায় দেননি।
মৃত আবদুল মালেকের ওয়ারিশরা জানান, তৎকালীন ভূমি কমিশনার (এসিল্যান্ড) গোলাম মুস্তাফা মুন্না (পরিচিতি নং ১৮১০৭) শুনানিতে মিস কেসের বাদী মো. জাকির হোসেনের উপস্থাপিত কাগজপত্র যথেষ্ট নয় বলে জানান এবং বিবাদী পক্ষ মৃত আব্দুল মালেক বেপারীর ওয়ারিশদের কাগজপত্র সঠিক বলে মৌখিক স্বীকৃতি দেন।
তৎকালীন ভূমি কমিশনার মোস্তফা কামাল মুন্না এ মিসকেসের রায়ের বিষয়ে পরবর্তীতে জানাবেন বলে শুনানি শেষ করে এবং বিষয়টি সার্ভেয়ার নুরে আলমকে নথিভুক্ত করতে নির্দেশ দেন।
এর পর দিনের পর দিন মৃত আব্দুল মালেকের ওয়ারিশদেরকে আজ আসেন, কাল আসেন বলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন সার্ভেয়ার নূরে আলম। এভাবে কেটে যায় ১৭ মাস।
এ বছরের ১৬ আগষ্ট সার্ভেয়ার নূরে আলম মৃত আব্দুল মালেকের ওয়ারিশদের হাতে একটি রায়ের কপি ধরিয়ে দেন। যেখানে সব কাগজপত্র সঠিক ও দখল থাকা সত্ত্বেও আব্দুল মালেকের ওয়ারিশদের বিপক্ষে রায় দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, সার্ভেয়ার নুরে আলমের হাত ধরে মামলার রায়ের আগে জমিটির নামজারিও হয়ে গেছে। অর্থাৎ মিস কেসের রায়ে তারিখ ১৬/৮/২০২২ লেখা থাকলেও জমিটির নামজারির তারিখ ২৮/৬/২২ লেখা। মানে মামলার রায়ের ১ মাস ২০ দিন আগে জমিটির নামজারিও হয়ে গেছে।
অথচ তাদের কাছে সব কিছুই পরিকল্পিতভাবে আড়াল করা হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব? মিসকেসের রায়ের আগে কীভাবে জমিটির নাম জারি করা হলো!তাছাড়া, আদালতে মামলা থাকা সত্ত্বেও সোনারগাঁও ভূমি অফিস রায় দিয়েছেন কীভাবে।
আব্দুল মালেকের ওয়ারিশদের অভিযোগ, সার্ভেয়ার নূরে আলম বলছেন, এ রায়ের আগে নাকি আমাদের কয়েকদফা নোটিশ পাঠিয়েছে। অথচ আমরা গত ১৭ মাসে কোন নোটিশ পাইনি। বরং দিনের পর দিন তার অফিসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলেও তিনি বলেছেন এখনও কিছু হয়নি, অপেক্ষা করেন পরে জানাব। এভাবেই কেটেছে প্রায় দেড় বছর। আর এখন তিনি বলছে, আমাদের নাকি কয়েক দফা নোটিশ করেছেন।
অভিযুক্ত সার্ভেয়ার নুরে আলম অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনিত সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার দাবি রায় দেওয়ার এখতিয়ার সহকারী কমিশনারের (ভূমি), আমার নয়।
সোনারগায়েঁর এসিল্যান্ড মো. ইব্রাহিম জানান, তিনি এখানে নিয়োগ পেয়েছেন বেশি দিন হয়নি। সার্ভেয়ার নুরে আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. এইচ এম সালাহউদ্দিন মঞ্জুর জানান, ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাইনি।
Leave a Reply